আদর্শ (পঞ্জিকা সাল)
কালনিরূপণবিদ্যা ও সময়কালকরণে আদর্শ হল সময়ের একটি ক্ষণ যাকে কোন নির্দিষ্ট পঞ্জিকা সালের উৎস হিসেবে বাছাই করা হয়। এই আদর্শ মানবিন্দু হিসেবে কাজ করে যে বিন্দু থেকে সময় হিসেব করা হবে।
আদর্শের মুহূর্তটি একতাবদ্ধতা বা আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত প্রথা থেকে চূড়ান্ত করা হয়। আদর্শ মুহূর্ত বা তারিখ একটি নির্দিষ্ট, স্পষ্ট, পরিবর্তনের স্পষ্ট ঘটনা, একটি আদর্শ ঘটনা হতে সংজ্ঞায়িত করা হয়। সালের মানদণ্ড-তে পৌঁছানো গেলে ক্রমাগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্তের মুহূর্তকে বাছাই করা হয়।
|
|
পঞ্জিকা সালগুলো
[সম্পাদনা]রাজকীয় সালগুলো
[সম্পাদনা]সরকারি জাপানি ব্যবস্থা বর্তমান সম্রাট থেকে বর্ষ গণনা শুরু করে এবং সিংহাসনে বসার বর্ষকে প্রথম বর্ষ ধরা হয়। এর মত একটি ব্যবস্থা চীনে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ছিলো যা সম্রাটের সিংহাসনে বসার তারিখের উপর নির্ভরশীল ছিলো (১৯১১ খ্রিস্টাব্দ ছিলো শুয়াংটোং সময়কালের তৃতীয় বছর)। ১৯১২ সালে চীনা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর প্রজাতান্ত্রিক সাল শুরু হয়। এটি এখনো তাইওয়ানে প্রচলিত রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ১৯৪৯ সালে (চীনা প্রজাতন্ত্রের ৩৮তম বছরে) কমন এরা গ্রহণ করে।
প্রাক-আধুনিক সালগুলো
[সম্পাদনা]- অলিম্পিক গেমসের চার বছরের প্রাচীন গ্রিক সাল অলিম্পিয়াড ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু হয়।
- নগরাব্দ (৭৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), রোমান রাজকীয় আমলে ব্যবহৃত হতো।
- খ্রিস্টাব্দ বা "কমন এরা" ব্যবস্থা এখনো গ্রেগরীয় ও জুলীয় বর্ষপঞ্জিতে ব্যবহার করা হয়, যা শুরু হয়েছে ডায়োনিসিয়াস এক্সিগুয়াসের নির্ধারিত যিশুর জন্মের তারিখ থেকে।[১]
- সৃষ্টাব্দ (পৃথিবী সৃষ্টির বছর থেকে) বাইজেন্টাইন বর্ষপঞ্জিতে ব্যবহৃত হতো (৫৫০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।
- সৃষ্টাব্দ (পৃথিবী সৃষ্টির বছর থেকে) হিব্রু বর্ষপঞ্জিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে (৩৭৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।[২][৩]
- ইসলামি বর্ষপঞ্জির "চন্দ্র বছর" হিজরি সন (হিজরতের বছর) বা এএইচ সাল (৬২২ খ্রিস্টাব্দ) থেকে শুরু হয়। সৌর বছরের তুলনায় এই বছরের গণনা পরিবর্তন হয় যেহেতু এটি একটি খাঁটি চন্দ্র বর্ষপঞ্জি। সরকারি ইরানি বর্ষপঞ্জি (আফগানিস্তানেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে) হিজরত থেকে বছর গণনা করে, কিন্তু যেহেতু এটি একটি সৌর বর্ষপঞ্জি তাই এর বছরের সংখ্যা ধর্মীয় বর্ষপঞ্জির সাথে মিলে না।
- হিন্দু বর্ষপঞ্জি বলতে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় বর্ষপঞ্জিকে বুঝায়। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল বিক্রম সংবৎ (৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ),[৪] যা বর্তমানে নেপাল ও বাংলাদেশের জাতীয় বর্ষপঞ্জিতে ব্যবহৃত হয়।
- বুদ্ধাব্দ ৫৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আদর্শ (বুদ্ধের পরিনির্বাণ-এর তারিখ) ব্যবহার করে।
- ইয়োরুবা বর্ষপঞ্জি (কোজোডা) ৮০৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দকে আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করে যাকে ঈশ্বর ওবাটালার ইলে-ইফের সৃষ্টির দিন ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হিসেবে মনে করা হয়।
আধুনিক সালগুলো
[সম্পাদনা]- বাহাই বর্ষপঞ্জির তারিখ বা'বের ধর্ম ঘোষণার বছরের (১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দ) মহাবিষুবের তারিখ থেকে শুরু হয়। বছরগুলো ১৯ বছরের ভাহিদ এবং ৩৬১ (১৯×১৯) বছরের কুল-এ-শায় নামে দলভুক্ত করা হয়।[৫]
- ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে থাইল্যান্ডে রাজা চুলালংকরন একটি জাতীয় থাই সালের ঘোষণা করেন যার তারিখ ব্যাংককের প্রতিষ্ঠাকাল ৬ এপ্রিল ১৭৮২ থেকে শুরু হয়। ১৯১২ সালে নববর্ষের দিন ১ এপ্রিলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৪১ সালে প্রধানমন্ত্রী প্লায়েক ফিবুনসংক্রাম ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্ব থেকে গণনার সিদ্ধান্ত নেন। এটি হল থাই বৌদ্ধ সাল যা থাই সৌর বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করে গণনা করা হতো। এই পঞ্জিকা সাল ব্যতীত বর্ষপঞ্জিটি ছিলো গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি।
- ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক বর্ষপঞ্জি হিসেবে ফরাসি সরকার ১৭৯৩-এর শেষের দিকে প্রায় বারো বছরের জন্য ব্যবহার করে আসছিলো। এর পঞ্জিকা সালের নাম "প্রজাতান্ত্রিক সাল" যা শুরু হত ২২ সেপ্টেম্বর, ১৭৯২ থেকে (যেদিন প্রথম ফরাসি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়)।
- ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা শকাব্দ (৭৮ খ্রিস্টাব্দ) অনুসরণ করে।
- মিঙ্গু বর্ষপঞ্জি তাইওয়ানের কর্মচারি ও এর পূর্বসূরীগণ ব্যবহার করতো। এর তারিখ শুরু হয় ১ জানুয়ারি, ১৯১২ তথা জিনহাই বিপ্লবের এক বছর পরে, যার ফলে চিং সাম্রাজ্যের পতন হয়।
- উত্তর কোরিয়া একটি ব্যবস্থা ব্যবহার করে যা ১৯১২ থেকে (= জুচে ১) তথা উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠায়া কিম ইল-সাংয়ের জন্মের সাল থেকে শুরু হয়।
- ফ্যাসিস্ট সাল মুসোলিনির ১৯২২ সালের রোমে পদযাত্রার তারিখ থেকে শুরু হয়। এটি শুধুমাত্র মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসনের অধীনস্থ দেশগুলোতে ব্যবহৃত হতো। এর ব্যবহার ১৯৪৫ সালে ইতালীয় সামাজিক প্রজাতন্ত্রের পতনের পর বিলুপ্ত হয়।
- রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত বৈজ্ঞানিক বর্তমান পূর্ব পদ্ধতিটির মানবিন্দু ১ জানুয়ারি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে।[৬][৭]
- ফ্রিম্যাসনরির বিভিন্ন শাখা মেসোনীয় সাল অনুযায়ী তাদের কাগজপত্রের তারিখ লিখনে বিভিন্ন তারিখ নির্ধারণ করেছে, যেমন লুসিস সাল (এএল)।
- হলোসিন বর্ষপঞ্জি আদর্শ হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ সাল তথা ভূতাত্ত্বিক সময়ে হলোসিন সালের সূচনা হিসেবে ব্যবহার করে।
অন্যান্য ব্যবহার
[সম্পাদনা]কম্পিউটিংয়ের আদর্শ বলতে সেই সময়কে বুঝায় যা শূন্যের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন, ইউনিক্স সময়কে সেকেন্ডের সময়ের মাধ্যমে ১ জানুয়ারি, ১৯৭০-এর ০০:০০:০০ ইউটিসি থেকে অধি সেকেন্ড ছাড়া শুরু করা হয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের আদর্শ বলতে এর অবস্থান এবং কক্ষপথের গণনায় সামঞ্জস্যতার আদর্শ মুহূর্তকে নির্দেশ করে। একটি সাধারণ জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় আদর্শ হলো জে২০০০, যা হচ্ছে ১ জানুয়ারি, ২০০০ খ্রিস্টাব্দ, স্থলজ গতিশীলতার সময়।
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]- সৃষ্টির তারিখ নির্ণয়
- ভূতাত্ত্বিক সময়
- সৌরচান্দ্রিক পঞ্জিকা
- মেটোনীয় চক্র
- সরস (জ্যোতির্বিদ্যা)
- মঙ্গল গ্রহে সময় নির্ধারণ
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Blackburn, B; Holford-Strevens, L (২০০৩)। "Incarnation era"। The Oxford Companion to the Year: An exploration of calendar customs and time-reckoning। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 881।
- ↑ Solomin, Rachel M.। "Counting the Jewish Years"। myjewishlearning.com।
- ↑ Lee, Scott E. (২০০৬)। "Overview of Calendars"। rosettacalendar.com।
- ↑ Dershowitz, Nachum; Reingold, Edward M. (২০০৮)। Calendrical Calculations (3rd সংস্করণ)। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 289। আইএসবিএন 978-0-521-70238-6।
- ↑ Richards, E. G. (২০১৩)। "Calendars"। Urban, S. E.; Seidelman, P. K.। Explanatory Supplement to the Astronomical Almanac (3rd সংস্করণ)। Mill Valley, CA: University Science Books। পৃষ্ঠা 616–617।
- ↑ Higham, Thomas। "Radiocarbon dating – Age calculation"। c14dating.com। Thomas Higham। জুন ১০, ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ডিসেম্বর ৩১, ২০০৯।
- ↑ Stuiver, Minze; Polach HA (১৯৭৭)। "Discussion; reporting of C-14 data."। Radiocarbon। University of Arizona। 19 (3): 355–363। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৫, ২০১৮।