বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন
বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যে আন্দোলন হয়েছিল তাই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত। বঙ্গভঙ্গ বাংলার ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০৫ সালের ৬ জুলাই কলকাতা প্রেস প্রথম বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের খবরটি প্রকাশিত করে। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবরে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বড়লাট লর্ড কার্জনের আদেশে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়। বাংলা বিভক্ত করে ফেলার ধারনাটি অবশ্য কার্জন থেকে শুরু হয়নি। ১৭৬৫ সালের পর থেকেই বিহার ও উড়িষ্যা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সরকারি প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বাংলা অতিরিক্ত বড় হয়ে যায় এবং ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এটির সুষ্ঠু শাসনক্রিয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত এখান থেকেই।কিন্তু ১৯১১ সালে, প্রচণ্ড গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়। দ্বিতীয়বার বঙ্গভঙ্গ হয় ১৯৪৭ সালে। এর ফলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতে যুক্ত হয়। এই পূর্ববঙ্গই পরবর্তীকালে পাকিস্তানের কাছ থেকে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।
সূচনা
[সম্পাদনা]বঙ্গ প্রদেশের আয়তন ছিল ১,৮৯,০০০ বর্গমাইল (৪,৯০,০০০ কিমি২) এবং জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৮৫ লাখ। বঙ্গের পূর্বাঞ্চল ভৌগোলিক এবং অপ্রতুল যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল হতে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৮৩৬ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে বঙ্গ থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধিনে ন্যস্ত করা হয় এবং ১৮৫৪ সালে বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব হতে গভর্নর-জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে অব্যাহতি দিয়ে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের উপর অর্পণ করা হয়। ১৮৭৪ সালে সিলেট সহ আসামকে বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে চিফ-কমিশনারশিপ গঠন করা হয় এবং ১৮৯৮ সালে লুসাই পাহাড়কে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।১৯০৩ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ বিবেচনা করা হয়। ছোটলাট এন্ড্রু ফেডার বাংলা ভাগের নতুন খসড়া করেন। তখন বঙ্গ হতে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাদ্বয়কে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাবও ছিল। তেমনিভাবে ছোট নাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে আত্তীকরণেরও একটি প্রস্তাব ছিল। ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকারীভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় এবং ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন বঙ্গের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এক সরকারি সফরের মাধ্যমে এই বিভক্তির ব্যাপারে জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে এই বিভক্তির বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দেন।
পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী (দার্জিলিং বাদে) বিভাগ এবং মালদা জেলা, আসাম প্রদেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে এই নতুন প্রদেশ গঠন করবে। এর ফলে বঙ্গ শুধু তার বৃহৎ পূর্বাঞ্চলই হারাবে না, তাকে হিন্দিভাষী পাঁচটি রাজ্যও মধ্যপ্রদেশকে ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিমে সম্বলপুর এবং মধ্যপ্রদেশের পাঁচটি ওড়িয়াভাষী রাজ্যের সামান্য অংশ বঙ্গকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ফলে বঙ্গের আয়তন দাঁড়ায় ১,৪১,৫৮০ বর্গমাইল (৩,৬৬,৭০০ কিমি২) এবং জনসংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লাখ যার মধ্যে ৪ কোটি ২০ লাখ হিন্দু ও ৯০ লাখ মুসলিম।
নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় "পূর্ব বঙ্গ ও আসাম" যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫৪০ বর্গমাইল (২,৭৫,৯০০ কিমি২) এবং জনসংখ্যা হবে ৩ কোটি ১০ লাখ, যাদের মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ মুসলিম ও ১ কোটি ২০ লাখ হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে এবং কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় থাকবে। সরকার নির্দেশ দেয় যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চিম সীমানা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকবে সাথেসাথে এর ভৌগোলিক, জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যাবলীও নির্দিষ্ট থাকবে।
১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ থেকে অস্থায়ী ভারত সচিবকে লেখা এক পত্রে উল্লেখ করেছেন 'বাঙ্গালিরা নিজেদের এক মহাজাতি মনে করে এবং এক বাঙ্গালি বাবুকে লাট সাহেবের গদীতে বসাতে চায়..... বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব তাদের এই স্বপ্নের সফল রূপায়ণে বাঁধা দেবে। আমরা যদি তাদের আপত্তির কাছে নতিস্বীকার করি তবে ভবিষ্যতে কোনদিনই বাংলা ভাগ করতে পারব না এবং আপনারা ভারতের পূর্বপার্শ্বে এমন এক শক্তিকে জোরদার করবেন যা এখনি প্রবল এবং ভবিষ্যতে বর্ধমান বিপদের উৎস হয়ে দাঁড়াবে।' [১]
কার্জন ইতঃপূর্বে গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে দার্জিলিং বাদে মালদাহসহ পুরো রাজশাহী বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের বাকি জেলাগুলো আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার পস্তাব করেন। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ আমলা রিজলি মন্তব্য করেছেন, সংযুক্ত বাংলা শক্তিশালী, বিভক্ত বাংলা বিভিন্ন দিকে আকৃষ্ট হবে। কংগ্রেস নেতারা এ ভয় করছেন। তাদের আশঙ্কা নির্ভুল এবং সেটাই এই প্রস্তাবের সবচেয়ে বড় গুণ। আমাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ব্রিটিশ রাজত্বের বিরোধী একটি সুসংহত দলকে টুকরো করে দুর্বল করে দেওয়া।' ঢাকায় লর্ড কার্জন এক ভাষণে ঘোষণা করেন মুসলিমদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আলাদা প্রদেশ রচনাই তার লক্ষ্য। ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজার ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ জেলায় ইতোমধ্যে তৎপর চরমপন্থীদের নতুন প্রদেশে দমন সহজ হবে বলে মন্তব্য করেন। লর্ড কার্জন মূল প্রস্তাবটি লন্ডন পাঠান ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ব্রিটিশ সরকারের ভারত বিষয়ক মন্ত্রী সেন্ট জন ব্রড্রিখ জুনে এই প্রস্তাব সঞ্চালন করেন।[২] সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯শে জুলাই, ১৯০৫ সালে এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর।
আন্দোলনের সূত্রপাত
[সম্পাদনা]বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব কার্যকর হবার আগেই ১৯০৫ সালের ৭ই জুলাই তারিখে সুরেন্দ্রনাথ তার 'দি বেঙ্গলী' পত্রিকার সম্পাদকীয়তে আসন্ন ঘটনাকে বলেছিলেন 'একটি ভয়ঙ্কর জাতীয় দুর্যোগ' এবং সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে সরকার যদি তার সিদ্ধান্ত না পাল্টায় তাহলে সামনে সর্বোচ্চ মাত্রার একটি জাতীয় প্রতিরোধ অপেক্ষমাণ রয়েছে। [৩][৪] বাস্তবেই এই ঘটনা এক প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের এই ধারণা হয় যে নতুন প্রদেশের ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বেড়ে যাবে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এই বিভক্তি মেনে নিতে পারল না এবং প্রচুর পরিমাণে জাতীয়তাবাদী লেখা এই সময় প্রকাশিত হয়। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রস্তাবকদের জন্য এক মর্মস্পর্শী গান আমার সোনার বাংলা লেখেন, যা অনেক পরে, ১৯৭২ সালে, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়।[৫] এই আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে বৃহৎ বঙ্গের অধিবাসী বাঙালি হিন্দু মুসলমানের চেতনার জগতে আলোড়ন সৃষ্টির জন্যই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য দেশাত্মবোধক সঙ্গীত রচনা, সুরারোপ ও চারণ কবিদের যত মিছিলে মিছিলে সেসব সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখ থেকে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ওই আইন কার্যকর হওয়ার কথা। সুতরাং ওই তারিখে রাজধানী কলকাতায় হরতাল আহ্বান করা হয়।[৬] সেদিন কোন বাড়িতে রান্নাবান্না হবে না। বাঙালি জনসাধারণ অরন্ধন পালন করে উপোষ থাকবে। বাংলার মহিলারাও ব্রত পালন করবেন। বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে হবে রাখিবন্ধন উৎসব।[৪][৭]
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা এবং তা কার্যকর করার পর বাংলায় সশস্ত্র আন্দোলন বিকাশ লাভ করে। ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশনে 'স্বরাজ' শব্দ গৃহীত হয়। স্বরাজ বলতে কংগ্রেসের নরমপন্থীরা বুঝলো ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন, চরমপন্থীরা বুঝলো স্বাধীনতা। এর থেকে উৎপত্তি হলো বিদেশী পণ্য বর্জন প্রসঙ্গ। চরমপন্থীরা চাইলো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ বয়কট।
ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার দেখিয়েছেন, স্বদেশী আন্দোলন তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল সে সময়। প্রথমধারাকে বলা যায় গঠনমূলক স্বদেশী। 'স্বদেশী সমাজ' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের গঠনমূলক কাজের কথা বিশদ করেছিলেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আত্মশক্তির উদ্বোধন। দ্বিতীয়ধারা বয়কটকে প্রাধান্য দিয়েছিল। তৃতীয়ধারায় ছিল চরমপন্থীরা। তাদের কাছে স্বদেশী আন্দোলন এবং বয়কট গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে ওঠে স্বরাজ। এ নিয়ে কংগ্রেসে তুমুল বিতর্কও হয়। এরই মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে জনমত সংগঠনের জন্য জেলায় জেলায় সমিতি গড়ে ওঠে। গৃহীত নীতি কার্যকর করার জন্য তৈরি করা হয় জাতীয় স্বেচ্ছাসেবীদল। বরিশালে 'স্বদেশ বান্ধব', ময়মনসিংহে 'সুহৃদ' ও 'সাধনা', ফরিদপুরে 'ব্রতী' আর সবচেয়ে বিখ্যাত ঢাকার 'অনুশীলন' সমিতি। জেলা সমিতির অধীনে অনেক শাখাও স্থাপিত হয়।কলকাতায় গড়ে ওঠে 'যুগান্তর' নামে আরেক সংগঠন।[৮] এই দলের নেতা অরবিন্দ ঘোষ। সহোদর বারীন ঘোষ তার সহযোগী। এরা অস্ত্র হিসেবে বোমা ব্যবহার চালু করেন।
চরমপন্থীদের ভূমিকা
[সম্পাদনা]চরম্পন্থীদের নেতা ছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলক এবং মূলত অরবিন্দ ঘোষ।অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন বিলাত ফেরত। আইসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েও তিনি চাকুরিতে যোগ দেননি। অরবিন্দ চরমপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন৷ তার চিন্তায় আপোসের কোনো জায়গা ছিল না৷ ১৯০৭ সালে অরবিন্দ বলেছেন, "প্রথমে এবং সবার আগে চাই রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে গ্রহণ করা; তা না করে জাতির সামাজিক সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, শিল্পে প্রসার ও নৈতিক উন্নতির চেষ্টা করাটা চরম অজ্ঞতা ও অর্থহীনতা ভিন্ন অন্যকিছু নয়৷"[[৯] ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, 'প্রকাশ্যে কংগ্রেসের মাধ্যমে এবং গোপনে বিপ্লবীদের মাধ্যমে অরবিন্দ যুগপৎ আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন। তার অনুসারীরা পুরোপুরি সন্ত্রাসবাদে ঝুঁকে পড়ে।' ১৯০৭ সালে সুরাটে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস সম্মেলনে লাঠালাঠি, চেয়ার ভাঙ্গাভাঙ্গি, মাথা ফাটানোর ঘটনা ঘটে।[১০] ব্রিটিশ সাংবাদিক নেভিনসন এই ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা রেখে গেছেন। অরবিন্দ ঘোষ পরবর্তীকালে লিখেছেন, 'আমি তিলকের (কংগ্রেস নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক) সঙ্গে পরামর্শ না করেই হুকুম দিয়েছিলাম কংগ্রেস অধিবেশন ভেঙ্গে দিতে।'
ঊনবিংশ শতকের শেষে ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের মূল হাতিয়ার ছিল পিস্তল, রিভলবার। আর এসময় বোমার অনুপ্রবেশ ঘটায় বাঙ্গালিরা। নেতৃত্ব ছিলেন এই অরবিন্দ ঘোষ। বারীণ ঘোষ 'যুগান্তর' নামে একটি উপদল গঠন করেন ১৯০৫ সালে অনুশীলন সমিতির কলকাতা শাখা ভেঙে। এই সমিতি বোমা তৈরি শেখার জন্য হেমচন্দ্র কানুণগো নামে একজন বিপ্লবীকে প্যারিসে পাঠায়। উন্নতমানের বিস্ফোরক তৈরি শিখতে হেমচন্দ্র সুইজারল্যান্ড ও প্যারিসে গিয়ে সুবিধা করতে না পেরে চলে যান লন্ডনে। সেখানে সুযোগ না পেয়ে ফিরে যান প্যারিসে। ফরাসি সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে এবং বিস্ফোরক রসায়ন ও বিস্ফোরক ঘটাবার কায়দা কানুন শিখে নেন। রুশ সন্ত্রাসবাদী দলের বিপ্লবী নিকোলাস সাফ্রানস্কির কাছে প্রশিক্ষিত হয়ে হেমচন্দ্র কলকাতায় ফিরে আসেন ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে। হেমচন্দ্র নির্মিত প্রথম বোমাটি কিংসফোর্ডকে ১০৭৫ পৃষ্ঠার বইয়ের ভেতরে করে পাঠানো হয়েছিল, যা বিস্ফোরিত হয়নি।[১১] মার্চ মাসে হেমচন্দ্র বোমা তৈরির স্কুল খোলেন পাঁচ ছাত্রকে নিয়ে। তার তৈরি বোমাটিই নিক্ষেপ করেছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। ক্ষুদিরামের এই ঘটনার পর পুলিশ বিভিন্নস্থানে হানা দিয়ে ৩৪ জন বিপ্লবীকে গ্রেফতার এবং বোমা বানানো বিষয়ক বইপত্র ও সরঞ্জাম আটক করে। [১২]
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুন কলকাতার মানিকতলা অঞ্চলে একটি বোমা প্রস্তুতের কারখানা আবিষ্কৃত হয়। এ ব্যাপারে অরবিন্দ ঘোষকে গ্রেফতার করা হয়। অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষ, উল্লাস কর দত্ত, কানাই লালসহ ৪৭ জন চরমপন্থী ধরা পড়েন।[৮]
বালগঙ্গাধর তিলক ১৯০৮ সালে ছয় বছরের কারাদন্ডে দণ্ডিত হন। অরবিন্দ ঘোষ ১৯১০ সালের দিকে পন্ডিচেরিতে চলে যান এবং সেখানে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন।[১৩]
বঙ্গভঙ্গ রদ
[সম্পাদনা]১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা কার্যকর হলে, হিন্দু জনগোষ্ঠী এর তীব্র প্রতিবাদ করে।তাদের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সংগ্রাম এক সময় সহিংস আন্দোলনে রুপ নেয় । প্রতিবাদের মুখে ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ ঐতিহাসিক দিল্লি দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদের কথা ঘোষণা করেন
সকল রাজনৈতিক প্রতিবাদের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে বঙ্গ আবার একত্রিত হয়। ভাষাতাত্ত্বিক এক নতুন বিভক্তির মাধ্যমে হিন্দি, ওড়িয়া এবং অসমীয়া অঞ্চলগুলো বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা হয়। এরই সাথে ১৯১১ সালেব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে নয়াদিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়।
ব্রিটিশ প্রতিক্রিয়া
[সম্পাদনা]বদরুদ্দীন উমরের ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন-থেকে জানা যায়-
"বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী যে আন্দোলন ১৯০৫ সালের পরে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করে সেটা প্রধানত মধ্যশ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এজন্য এই শ্রেণীর উপরই সরকারের নির্যাতন সবথেকে বেশি হয়। পূর্ব বঙ্গ ও আসামের লেফটেনান্ট গভর্নর ব্যাম্পফিল্ড ফুলার বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে নির্যাতন শুরু করেন এবং সেই সঙ্গে বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেন সাম্প্রদায়িকতা। তিনি ঘোষণা করেন যে তাঁর দুই স্ত্রী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে মুসলমানই হলো প্রিয়পাত্রী। এই সময় বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকারীরা বঙ্কিম রচিত 'বন্দে মাতরম' সঙ্গীতকে জাতীয় সঙ্গীতের পর্যায়ে নিয়ে যান ও তার ব্যাপক প্রচার করেন। ফুলার বরিশালে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কনফারেন্সের অধিবেশনে 'বন্দে মাতরম' সঙ্গীত গীত হলে পুলিশ দ্বিতীয় দিনে লাঠি চার্জ করে সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই পুলিশী নির্যাতন সত্ত্বেও আবদুর রসুলের সভাপতিত্বে বরিশালের এই অধিবেশনে সরকারের সঙ্গে অসহযোগীতা, বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা, ব্রিটিশ পণ্য বর্জন ইত্যাদি সম্পর্কে কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।"
মুসলিম প্রতিক্রিয়া: বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা শুনে পূর্ব বঙ্গের মুসলিমরা, বিশেষ করে অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় হতাশ হয়ে পড়ে। 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামের নতুন প্রদেশ গঠিত হওয়ায় তাদের মধ্যে যে উৎসাহ, প্রাণচাঞ্চল্য ও জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা তা স্তব্ধ করে দেয় । এর ফলে চরম হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ সুমিত সরকার,The Swadeshi Movement in Bengal 1903-1908, নয়া দিল্লী ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ১৯. “The Bengalis, who like to think themselves a nation, and who dream of a future when the English will have been turned out, and a Bengali Babu will be installed in Government House, Calcutta, of course bitterly resent any disruption that will be likely to interfere with the realisation of this dream. If we are weak enough to yield to their clamour now, we shall not be able to disseminate or reduce Bengal again; and you will be cementing and solidifying on the eastern flank of India, a force already formidable and certain to be a source of increasing trouble in the future.”
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০০৯।
- ↑ রমেশচন্দ্র মজুমদার, History of the Freedom Movement in India, vol. II, কলিকাতা, ১৯৬৩, পৃষ্ঠা ৭
- ↑ ক খ http://www.natun-diganta.com/archieves/3rd%20year/4th%20edition/jatiotabad.html ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে জাতীয়তাবাদ, সামপ্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি -সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
- ↑ http://www.thedailystar.net/story.php?nid=78124
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৩০ নভেম্বর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০০৯।
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ অক্টোবর ২০০৯।
- ↑ ক খ http://www.dailysangram.net/archive/news_details.php?news_id=4604&publication_date=2009-04-09[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী"। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ মে ২০১০।
- ↑ [A History of India/Hermann Kulke and Dietmar Rothermund.—3rd ed. page 263 ISBN: আইএসবিএন ০-২০৩-৭৫১৬৯-৮ ]
- ↑ http://www.dhakanews24.com/bangladesh-memorial/3064.html[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ অক্টোবর ২০০৯।
- ↑ [A History of India/Hermann Kulke and Dietmar Rothermund.—3rd ed.আইএসবিএন ০-২০৩-৭৫১৬৯-৮ page 263]
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |